মনের যতরকমের পরিস্থিতি হয়, সে পরিস্থিতি অনুযায়ী আমি মনে করি বিভিন্ন ধরনের গান সুর ও তাল তার সহযোগিতা দিতে পারে। ছড়াগান বা ছন্দমূলক কবিতা আবৃত্তি যদিও এক পুরাতন ও বিশ্বজনীন সংস্কৃতি, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ইত্যাদি বড় শহর থেকে ৯০ দশকে এর বিদ্রোহী কাব্য রূপে একটি ধারা সৃষ্টি হয়, যার নাম র্যাপ। র্যাপ অন্যান্য শিল্প আকৃতির মতনই সে রুপকারকে তার মনের অনুভূতি প্রকাশ করার এক মঞ্চ দেয়। র্যাপ করার জন্যে কেবল একজনের মগজ দরকার, কোন যন্ত্রপাতির দরকার পড়ে না। বড় জোর একটা টেবিলে তাল বাজানো যায়। যেহেতু এ রীতি এত সহজ (ওপর থেকে), আমার মনে হয় এতে শিল্পী অনেক বেশী তেজ আনতে পারে তার ভাবপ্রকাশে, অনেক বেশী সত্যতা থাকে তার নৈরাশা ও আনন্দে, তার ব্যাঙ্গ ও সোজা কথাতে।
বড় হওয়া কালীন হাথের মুঠোয় আমেরিকায়ে তৈরি ইংরেজি ভাষায় র্যাপ সঙ্গীত তো ছিলই, মায়ামিতে থাকার ফলে আমি এটাও দেখতে পাচ্ছিলাম যে আমেরিকাতে বসবাস করা অন্যান্য দেশ থেকে আসা (বেশীরভাগ ল্যাটিন আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ) সমাজেরা কিভাবে এ র্যাপ ও হিপহপ জগতের সাথে মিলেমিশে তারা নিজেদেরও সঙ্গীত পরম্পরাতে এ নতুন সক্রিয়তা আনছিল। যে কোন শিল্প আকৃতির ক্ষেত্রে, যখন এক জাত থেকে আরেক জাতে সেইটি আশ্লেষ হয়, তখন কোন শিল্পী সেটাকে ভালো করে করতে পারে, আবার অনেকে বোকা বোকা শোনায়। সময় এবং নৈকট্যের সাথে সাথে সক্ষম উদাহরণগুলি বাড়তে থাকে, আর বাজেগুলো আড়ালে চলে যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে সে নতুন শিল্প আকৃতির মূল ভাবটা ঠিক করে চেনা ও বোঝা, এবং তারপরে নিজের বাস্তব জগতে নিজের ভাষায় অন্তরীণ করা।
যেমন কিছুদিন আজকাল বাঙলা ভাষায় কাওয়ালী গান হচ্ছে।
এইটা এক খুবই স্বাভাবিক ক্রমবৃদ্ধি বাঙলা লোকগীতির জগতে। ভোউগলিকভাবে পাশেই আছে বিহার এবং বাকি উর্দুভাষী এলাকা, সুতরাং এ সঙ্গীতগোত্র যে এতদিন কেবল উর্দুভাষী আর পাঞ্জাবিভাষী হিসেবে পরিচিত ছিল, সেইটি কোন না কোনদিন তো বাঙলাতে আসতই। কিন্তু একেবারে সোজা কপি মারেনি কিন্তু বাঙলার বাউল শিল্পী, বাউল সংগিতধারার ছাপ একদম স্পষ্ট।
সেভাবে আমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিলেতি শাসনের ফলে সে ইউরোপীয় গানের ছাপ আছে। তারপরের বাঙলা আধুনিক যে গান হয়েছিল ওই ৭০ দশকে, ওইগুলো শুনলে বোঝা যায় যে খুবই আমেরিকা-মুখি হয়ে দাঁড়িয়েছিল শিল্পীরা নতুন চিন্তা ও প্রেরণার জন্যে। আজকের ইন্টারনেটের যুগে আরও সহজ হয়ে গেছে এক রীতির মূল চর্চা করার, বিশাল ভৌগলিক দূরত্ব থাকা সত্বেও। আর বাঙালি নতুন প্রজন্ম খড়খড়ে মেটালের পাগলামিতে আটকে নেই (যদিও এখনও দুঃখের কথা এরা সবাই বাংলাদেশ থেকে, একজনও কেউ আমার পশ্চিমবাংলার নয়)।
আমার কিছু প্রিয় বাঙলা ভাষায় র্যাপারদের এ ব্লগমঞ্চে উপস্থাপন করি। প্রথম হচ্ছে নিজাম রব্বী। সাংঘাতিক বাঙলা ভাষা কাব্যের সাধক। এই “অন্ধকার” কবিতার ভাব কেমন যেন আমাকে আঁকড়ে ধরতে পারে। অন্তরের একদম গাঢ় এলাকার সাথে যেন দেখাসাক্ষাত মেলামেশা করছেন কবি। যেটা আমার কাছে বিশেষ করে আকর্ষণিয় এ নিয়ে হচ্ছে যে নিজ মাতৃভাষায় এখন সে মনোভাবের সাথে আলোচনা করা যাচ্ছে, যা হয়ত আগের প্রজন্মের সাহিত্যে শ্রেণিভেদের কারনে সেখানগুলো পৌঁছনো যেত না, বা খুবই কৌশলীভাবে পাওয়া যেত…তাকে স্ফুট করা হয়েছে, আর এতেও এক সৌন্দর্য আছে। ভিডিও আর কথা নিচে দিচ্ছি
“কেন আমি এই মৃত্যু স্তূপে? হঠাত করে করে হামলা কারা হিংস্র রূপে রাত দুপুরে? অন্ধকারে করে নাড়াচাড়া, বন্ধ আমি ধ্বংস পুরে! খেয়ে যায় কার দেখ মাংস পুরে, অন্ধ সেজে ভন্ড পরী বদলে যায় সাথে সাথে এক ভয়াবহ পেতনি maybe, I’m stuck! নিজের ছায়া দেখে আঁতকে উঠি এই এই কে ওখানে? মস্তিষ্কে এক ধাক্কা ভারি, আরে…কেন জানি হঠাত ঝাপসা লাগে চোখে। ঘড়ির কাটায়ে ঝুলছে মাথা, দুলছে দোলনা কিন্তু কোন মানুষ ছাড়া। এত বেশী কাল ধোঁয়া এত বেশী অত্যাচার! চার পাশে ভেসে যায় যেন রক্ত স্রোতে! কেন? গিলে নেয় আমায়ে, টেনে ছিঁড়ে দেয় কোন এক আজব শক্তি লক্ষ্মী সাজে, ভক্তি না এসে উপচে বমি আসে! ছয় ছয় ছয় বলে মূর্তি হাসতে থাকে আঃ! সহ্য হচ্ছে না আর আমার, মৃত্যু তাকেই দরকার! যেন বেঁচে থাকা মানে torture! কেন? আমাকেই শুধু দরকার…মুক্তির স্বাদ খুঁজে বেড়াই, ধারালো ছুড়িটা চালাই গলায়ে…আত্মার সাথে যুদ্ধ শুরু! এই দেখি এইবার কে কাকে হারায়ে!”
ওপরেরটা কেবল একটি উদাহরণ ছিল এই বিদ্রোহীকাব্য আবৃত্তির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ র্যাপ শিল্প আকৃতির। র্যাপের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে ফ্রিস্টাইল। এটিও আমরা বাঙলার পুরাতন সংস্কৃতিতে পাব কবির লড়াইয়ের রূপে। দেখি কিভাবে রাস্তায় রাস্তায় এ র্যাপগান আমাদের বাঙলা ভাষাকে নতুন অন্বেষণে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিভা ও পরিশ্রম না হলে এরকম হালকা মজা করা যায় না।
অবশ্যই এরকম এক যন্ত্রের ব্যবহার রাজনৈতিক ব্যাপারে যোগদান করা স্বাভাবিক। হীরক রাজার দেশের বাউল শিল্পী যেমন রাজার দরবারে এসে রাজাকে শুনিয়ে গেছিল কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়, তেমনি এই র্যাপগানে সেরকম কথা জড়ানো হচ্ছে বাঙলা ভাষায়। এতে আমার মতে সবচেয়ে দক্ষ হচ্ছেন তৌফিক।
যাক অনেক ভিডিও দিলাম এবার। আরেকজনদের নাম উল্লেখ করব, জ্বালালি সেট। এদের নতুন অ্যালবাম বেরিয়েছে, বনবাসের সাধন নামের। ওদের সেদিন ইন্টার্ভিউ দেখছিলাম, বহুত পরিশ্রম করেছে এ কাজের জন্যে, আর প্রচুর মেধাবী ছেলেগুলো। অনেক ওখানকার আঞ্চলিক বাঙলা ভাষার ব্যবহার করে বলে কথা বুঝতে অসুবিধে হয় আমার, কিন্তু এতেও আমি এক আনন্দ পাই কেননা শিল্পী নিজের অন্তরের কথা বাড়ির ভাষায় বললে একটা সাধুতা অনুভব করা যায়। বেশ কিছুবার মন দিয়ে শুনতে হয় এ ক্ষেত্রে। আর র্যাপগান কিন্তু মন দিয়ে শোনারই বস্তু। প্রত্যেকটি কথার মূল্য আছে কেননা এখানে কথাই সমস্ত। “Mood setting” এর সঙ্গীতধারা নয়।